।। মুন্সি আব্দুল কাদির।।
বন্ধু প্রতিদিন আমরা নামাজ আদায় করি।্ নামাজের আজান, ইকামাত, তাকবীরে তাহরিমা একটি কথা বার বার স্মরণ করে দেয়, বান্দা এই দেখ আজান হয়েছে, জামাত দাড়াতে আর মাত্র কয়েক মিনিট, ইকামত আমাকে বলে দেয় অলসতা ছেড়ে দাও জামাত শুরু হয়ে গেছে এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ইমাম তাকবীরে তাহরীমা বলে ফেলবেন। একটু অলসতা তোমাকে তাকবীরে তাহরীমা মাহরুম করে দিবে। দেখ আজান ও ইকামাতের মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিট ফারাক। ইকামাত ও জামাতের মধ্যে মাত্র কয়েক সেকেন্ড ফারাক। বন্ধু তোমার জন্মের পর পর ই তোমার ডান কানে আজান আর বাম কানে ইকামাত হয়ে গেছে। তোমার জীবনের একমাত্র জামাতের কাজটাই বাকি। অর্থাৎ তোমার বিদায়ের জামাত হতে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি রয়েছে। এই কয়েক সেকেন্ডের জন্য তুমি যদি গাফেল হয়ে যাও, তোমার জামাত ফউত হয়ে যেতে পারে। তোমাকে রূহের জগতে মাওলার স্বীকৃতির ঘোষনা তোমার কানে আজান ও ইকামাত দেওয়ার সময় শুনিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই ধরাতে তুমি এসেছ। তোমার আগমনের শুরুতে মাওলার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষনা শুনে তুমি পৃথিবীর জীবন শুরু কর। মাঝ খানে মাত্র কয়েক মিনিট/সেকেন্ড তুমি পৃথিবীকে আবাদ করবে।
তারপরই তোমাকে আবার মাওলার কাছে চলে যেতে হবে। এই খানিক সময় হয়তে দুনিয়ার সময়ের হিসাবে ৫০, ৬০, ১০০ বছর হতে পারে। কিন্তু আখেরাতের হিসাবে ২ মিনিটের বেশি নয়। যারাই এই খানিক সময়ে আল্লাহকে ভুলে গেছে, তারাই অভিশপ্ত, গোমরাহ, পথহারা। আল্লাহ ওয়ালাগন বলতেন, বন্ধু দুনিয়াতে তুমি যতটুকু সময় থাকবে ততটুকু সময়ের জন্য কাজ কর, আখেরাতে তুমি যতটুকু সময় থাকবে সে অনুযায়ী আখেরাতের কাজ কর। দুনিয়ার জীবনে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় সম্পদ, সম্মান, নারী, আমোদ প্রমোদ, ক্ষমতা ইত্যাদির কারণে। তবে বেশির ভাগ মানুষের মোহ থাকে সম্পদের দিকে। অথচ সে সম্পদের বেশির ভাগই আমরা রেখে যাই। তাতো আমার না। আমার ওয়ারিসগনের। ওয়ারিসগনের সম্পদের জন্য আমার রাত দিনের সব চেষ্টা। আমার জন্যতো আমার প্রয়োজন তিন বেলা খাবার, দুই জোড়া কাপড়, অসুখে চিকিৎসা, মাথা গুজার একটুকু জায়গা। আমার আসল সম্পদ আমলের জন্য আমার চেষ্টা নেই অথবা তাড়াহুড়া। এই যৎসামান্য চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিদিন আমি নামাজে সুরা ফাতেহার শেষাংশে পড়ি গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন। হে আল্লাহ আমাকে তোমার অভিশ¤পাত প্রাপ্তদের এবং পথভ্রষ্টদের পথে চালিত করুন। এই পাঠ কমপক্ষে ৩২ বার আউড়িয়ে যাই। আমার অনুভুতি ভোঁতা হয়ে গেছে। চিন্তার জগতে পর্দা উঠেছে। আমি যাদের পথ থেকে বাঁচতে চাই। প্রথমত হল, ইবলিশের কুমন্ত্রণা থেকে। সে হল আল্লাহ তায়ালার প্রথম অভিশপ্ত ব্যক্তি। তার প্রথম কাজ আল্লাহর আদেশের বিরোধীতা করা। আর এই বিরোধীতা করেছে ফখর, অহংকার আর বড়ত্বের অহমিকার কারণে। এই ফখর আর গর্ব তাকে আল্লাহর নাফরমানি করতে উদ্বুদ্ধ করে। চির দিনের জন্য লানত প্রাপ্ত হয়। জান্নাত থেকে চির জাহান্নামের নজরানা পায়।
আমরা প্রতিদিন গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন পড়ি। কিন্তু চিন্তা কি করি চির দুশমন শয়তানের কাজ থেকে, তার আক্রমণ থেকে কীভাবে বেঁচে থাকব। আদম আঃ এর সামনে দ্বিতীয় যে অপরাধটি হয়েছে তা হল বন্ধু বেশে প্রতারণা, মিথ্যা বলে মানুষকে ধোঁকায় ফেলা। আল্লাহ তায়ালা আদম আলাইহিস সালাম কে নির্দেশ দিলেন তোমরা ঐ গাছটির ফল খাবে না। আদম আলাইহিস সালাম ও এই নির্দেশ মেনে চলছেন। শয়তান এসে প্ররোচনা দিল হে আদম আমি কি তোমাদেরকে এমন গাছের কথা বলে দেব না, যে গাছের ফল খেলে তোমরা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। এই জান্নাত থেকে তোমাদের আর বের করে দেওয়া হবে না। আদম আলাইহিস সালামতো মিথ্যা কি জিনিস বুঝতেন না। তারা খুব সহসাই শয়তানের চক্রান্তের কাছে কাবু হয়ে গেলেন। দুজনেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেলেন, অনুতপ্ত হলেন, ক্ষমা চাইলেন। শয়তানের মত অহংকারের বশে যুক্তি উত্থাপন করলেন না। শয়তান জান্নাতেই আদম আলাইহিস সালাম এর সামনে দুটি অপরাধ করেছে। এক অহংকার করে সরাসরি আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে। দুই মিথ্যা বলেছে, প্রতারণা করেছে, ধোঁকা দিয়েছে। এই অহংকার, মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা থেকে আমি পানাহ চাই। তাইতো পড়ি গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন। শয়তান আদম আলাইহিস সালাম এর ছেলে দ্বারা অপর বোনের প্রতি আকৃষ্ট করাল এমন কি হাবিলকে হত্যা পর্যন্ত করাল। তাইতো আমি শয়তানের এই অভিশপ্ত কাজ থেকে বাঁচতে বার বার পড়ি গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন।
পৃথিবীতে আল্লাহর সরাসরি গজবে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে। কোরআনুল
কারীমে কয়েকটি জাতি ধ্বংসের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে। তারা যে অপরাধ করেছিল এই
অপরাধগুলো এখনো চলমান বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। আমরা প্রতিদিন
তাদের এহেন অপরাধ থেকে এবং গজব থেকে বাঁচতে মাওলার কাছে নিবেদন পেশ করি গাইরিল
মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন। আমাদের অবস্থা এমন হয়েছে যে হাতে তাসবীহ, মুখে ইস্তেগফার, আর কর্মে পাপের সয়লাব। এই পড়া, এই গণনায় আমাদের কী উপকারে আসবে আজ ভাবার প্রয়োজন। সওয়াব যতই কম হোক সঞ্চয়
করতে থাকলে এক সময় পাত্র ভরে যাবে, যদি তলায় পাপের ছিদ্র না
থাকে। আমি সওয়াবের অনেক কাজ করতে থাকি আর পাপের ছিদ্রগুলো বন্ধ না করে পাল্লা দিয়ে
পাপ করতে থাকলে সওয়াব যতই বেশি হোক নীচের ছিদ্র সব ঝরে যাবে। বড় একটি ট্যাংকিতে
যদি বড় পাইপ দিয়ে পানি ঢালতে থাকি আর নীচে ছিদ্র দিয়ে পানি সরে যায় তবে আজীবনেও কি
ঐ ট্যাংকি ভরা যাবে? না তা কখনোই ভরবে না। অন্যদিকে তলায় ছিদ্র না থাকলে ফোঁটা
ফোঁটা পানিও যদি জমতে থাকে, একদিন এই ট্যাংকি পূর্ণ হয়ে
যাবে। সওয়ার কামাই করার চেয়ে গুনাহের কাজ ছেড়ে দেওয়া অনেক অনেক কঠিন কাজ। পৃথিবীর
ধ্বংস প্রাপ্ত জাতি গুলো তাদের গুনাহ, অপরাধের কারণে ধ্বংস হয়েছে।
আমি যদি গুনাহের কাজ ছাড়ার চেষ্টা না করে প্রতিদিন শত হাজার বারও গাইরিল মাগদুবি
আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন পড়তে থাকে আমার এতে কি লাভ হবে? একটু ভাবার কি প্রয়োজন নেই। আমি যখন পড়ি গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ
দোয়াল্লিন তখন কি আমার চোখের সামনে এই লানত প্রাপ্ত জাতি গোষ্ঠীর চিত্র ভেসে উঠে ?
আমার মন কি করজোরে মাওলার কাছে নিবেদন পেশ করে, হে আল্লাহ আমার যত অপরাধ আছে এই অপরাধগুলো থেকে আমি মুক্তি চাই। আমাকে মুক্তি দাও। আমি অনেক সময় ভাবি এটা বড় পাপ, এটা ছোট পাপ। মানুষ ছোট পাপ করতে করতেই বড় পাপের দিকে ধাবিত হয়। একদিনে একজন ডাকাত বড় ডাকাত হয়ে যায় না। একদিনেই কোন সন্ত্রাসী বড় সন্ত্রাসী হয়ে যায় না। ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে বড় অপরাধী হয়। ছোট পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করলে বড় পাপ থেকেও বাঁচা যাবে। ছগিরা গুনাহ কবিরা গুনাহের দরজা খুলে দেয়। আমরা সাপ এবং আগুন নিয়ে এটি বুঝতে পারি। সাপ যত ছোটই হোক আমরা ভয় পাই। সাপ ছোট হোক আর বড় হোক তার ছুবলে আমি মারা যেতে পারি। ছোট বলে তাকে অবহেলা করি না। হয়তোবা বড় সাপ দেখলে একটু বেশি ভয় আসে। আগুনের অঙ্গার ছোট হোক বড় হোক কেউ হাতে নেয় না, যে ছোট টাতেও হাত পুড়বে। পূর্বের যুগে যারা সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিমের দলভুক্ত ছিলেন। তারা যে সারা দিন ইবাদতে বসে থাকতেন এমনটি নয়। তাদের আসল কাজ ছিল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারলে কম বেশি সওয়াব সঞ্চয় হবেই। তারা আল্লাহর ভয় নিয়ে চলতেন। আমাকে একদিন পাকড়াও হতেই হবে। আমার আমলের রেকর্ড কিপার আমার কাঁধেই বসানো আছে। এমন রেকর্ড কিপার যাদের কাজের অলসতা নেই। ঘুমের ঝিমুনি নেই। কর্মের ক্লান্তি নেই। প্রভুর আদেশের সামান্য অবাধ্যতা নেই।
কোন একটি ছোট ভাল বা মন্দ কাজ চোখ এড়িয়ে যায় না। এই চিন্তা করে করে যদি আমি প্রভুর নিকট তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আসামির মত দু হাত বেধে নিবেদন করি গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন তবে আমার এই নিবেদন হবে যথার্থ। আমার নিবেদন প্রভুর নিকট হবে খুবই পছন্দের। পথ ভ্রষ্ট আর গজব প্রাপ্তদের দলে আল্লাহ আমাকে কখনোই নিবেন না। তাইতো আমাকে দেখতে হবে গজব প্রাপ্তরা কি কি কারণে গজব প্রাপ্ত হয়েছে, লানত প্রাপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে চির লানত প্রাপ্ত করেছেন। অনেক জাতিকে তাদের পাপের জন্য ধ্বংস করে দিয়েছেন। অনেক কাজ করতে নিষেধ করেছেন। এই নিষেধকৃত কাজগুলো বাঁচার চেষ্টা করতে পারলেই কেবল আমরা গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন পড়ার সাথে কাজ করার চেষ্টা করছি বুঝা যাবে। অন্যথায় শুধু পড়েই গেলাম কোন কাজে আসবে কি না অনিশ্চিত। এক সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি অনেক বড় ইবাদাত গুজার বান্দা হতে চাই। আমার কি করতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বললেন, সকল হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বেঁচে থাক। তাহলে তুমি সবচেয়ে বড় ইবাদাত গুজার বান্দা হয়ে যাবে।
এই পৃথিবীতে কেউ জবানের পাপ দ্বারা, কেউ হাতের পাপ দ্বারা, কেউ লজ্জাস্থানের পাপ দ্বারা ধ্বংস হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করি সকল পাপ থেকে বাঁচতে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দোয়াল্লিন পড়া অনুযায়ী পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করার তৌফিক দিন। আমীন।
লেখক:
কবি, প্রাবন্ধিক
ও ব্যাংকার
মোবাইল: ০১৭২৩১০৫২৮৮
0 coment rios:
You can comment here