।। ইমাম মাওলানা এম. নুরুর রহমান।।
সত্যের সন্ধানে
পর্ব-৮
সত্যের সন্ধানে পর্ব-৭ পড়তে ক্লীক করুন এখানে
পূর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর
আল-কুরআনের কাব্যিক ও শৈল্পিক মু‘জিযা
১) অভিনব প্রকাশ ভঙ্গি ঃ
আল কুরআনের অভিনব
প্রকাশ ভঙ্গি একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ মু’জিযা। দেড় হাজার
বছর পূর্বের কুরআনের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি তৎকালীন আরবরা যেমন বুঝেছিলেন আজকের সব মানুষও
ঠিক তেমনি বুঝে থাকেন। নি¤েœ
আল-কুরআনের অভিনব প্রকাশ ভঙ্গির কতিপয় উদাহরণ কুরআন থেকে তাদের
হলো ঃ
ক) প্রশ্নবোধক বাক্য ঃ
আল কুরআনের প্রকাশ
ভঙ্গির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রশ্নবোধক বাক্য। প্রশ্নবোধক বাক্যের অবতারণা করে প্রকাশভঙ্গিকে
সতেজ,
সাবলিল করে তোলা হয়েছে। সূরা আর রাহমানে ইরশাদ হচ্ছে,
مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ
بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لَا يَبْغِيَانِ
فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
“তিনিই মুক্তভাবে
প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া,
যারা পরষ্পর মিলিত হয়ে থাকে কিন্তু উভয়ের মধ্যে রয়েছে এক পর্দা
যা তারা অতিক্রম করতে পারেনা। অতএব তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার
করবে?”
আল-কুরআন, সূরা আর রাহমান : ১৯-২১।
এখানে আলাহতা’আলা মানুষের জন্য তাঁর
দেয়া বিভিন্ন নিয়ামতের কথা উলেখ করেছেন এবং সাথে সাথে
প্রশ্ন রেখেছেন মানুষ তার কোন নিয়ামতকে অবিশ্বাস বা অস্বীকার করতে পারবে অর্থাৎ অবিশ্বাস
বা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র অবকাশও নেই।
এমনিভাবে সূরা
বাকারার ৪৪ নং আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রশ্নবোধক বাক্য দিয়ে শুধু সাধারণ অর্থের হ্যাঁ বোধক বক্তব্য
পেশ করা হয়নি। বরং সেটার দ্বারা মানুষের মনের কাছে প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে এবং এই প্রশ্নবোধক
বাক্যের কারনে মানুষ অধিকতর মনযোগের সাথে বিষয়টি নিয়ে ভাববে।
এই আয়াতে বর্ণনা
করা হয়েছে ঃ
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ
بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا
تَعْقِلُونَ
“তোমরা কি শুধু
অন্য লোকদের সৎ কাজের আদেশ দেবে আর নিজেদের কথা একেবারে ভুলে থাকবে যদিও তোমরা কিতাব
পাঠ করে থাক,
তবে কেন তোমরা বুঝনা?” আল-কুরআন,
সূরা বাকারা : ৪৪।
খ) প্রশ্ন ও উত্তর ঃ
আল কুরআনের প্রকাশ
ভঙ্গির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রথমে প্রশ্ন রাখা এবং তারপর সেই বাক্যেই অথবা পরবর্তী
বাক্যে উত্তর সূচক বক্তব্য রাখা।
যেমন আলাহ তা’আলা বলেন ঃ
أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ بَلَى وَهُوَ
الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ إِنَّمَا أَمْرُهُ
إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
“যিনি আসমান ও
জমিন সৃষ্টি করেছেন,
তিনি কি এরকম আরও জিনিস তৈরি করতে সক্ষম নন? অবশ্যই সক্ষম, তিনি তো শ্রেষ্ঠ
সৃষ্টিকর্তা,
যিনি সবকিছুই জানেন। তার সৃষ্টিকার্য এরূপ যে, তিনি যখন কোন কিছু সৃষ্টি করতে ইচছা করেন তখন তাকে বলেন, হও! আর অমনি তা হয়ে যায়।” আল-কুরআন,
সূরা ইয়াসিন : ৮১-৮২। সূরা আল ইমরানে আলাহ তা‘আলা বলেন ঃ
فَكَيْفَ إِذَا جَمَعْنَاهُمْ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ
وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
“এরপর যেদিন আমি
তাদেরকে একত্রিত করবো যাতে কোন সন্দেহ নেই। সেদিন তাদের অবস্থা কেমন হবে? আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা উপার্জন করেছে তা পরিপূর্ণভাবে তাকে
প্রদান করা হবে,
আর তাদের প্রতি কোন জুলুম করা হবে না?” আল-কুরআন, সূরা আল ইমরান : আয়াত
২৫।
এখানেও আমরা প্রশ্ন
দেখতে পাই। প্রশ্নের ধরণ দেখেই ব্যাপারটা আঁচ করতে পারি, তবু উত্তর তাদের হয়েছে যাতে বুঝতে সহজ হয়।
গ) প্রশ্নবোধক উপমা
প্রশ্নবোধক বাক্য
ব্যবহারে আর একটা বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ্য করি কুরআনের আয়াত সমূহে। প্রশ্নবোধক বাক্য
ও উপমা এর আলাদা আলাদা ভাষা অলংকার এবং এই দুয়ের সংমিশ্রণ কোথাও কোথাও আমরা দেখতে পাই।
যেমন আলাহ তা’আলা বলেন,
أَفَمَنْ يَمْشِي مُكِبًّا
عَلَى وَجْهِهِ أَهْدَى أَمْ مَنْ يَمْشِي سَوِيًّا عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
“সুতরাং যে ব্যক্তি
উপুড় হয়ে নিজের মুখের উপর ভর দিয়ে চলে, সেই ব্যক্তি কি
সৎপথে চলে,
না ঐ ব্যক্তি যে সোজাভাবে সরল সঠিক পথে চলে?” আল-কুরআন, সূরা মুলক : ২২।
উপুড় হয়ে নিজের
মুখের উপর যে ব্যক্তি চলে,
সে দ্রুত চলতে পারে না এই সহজ কথাটিকে আরো জোরের সাথে বলার জন্য
উপমার সাহায্যে তুলনা করে ব্যক্ত হয়েছে। এই উপমা ও প্রশ্নবোধক বাক্যের সংমিশ্রনের ফলে
বক্তব্যে প্রখরতা আসে।
এধরনের আরও উদাহরন
সূরা হুদ এ পাওয়া যায়। যেমন আলাহতা’আলা বলেন ঃ
مَثَلُ الْفَرِيقَيْنِ كَالْأَعْمَى
وَالْأَصَمِّ وَالْبَصِيرِ وَالسَّمِيعِ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا أَفَلَا
تَذَكَّرُونَ
“দুটি দলের মধ্যে
উপমাঃ একটি অন্ধ ও বধির এবং অপরটি দেখতে পায় ও শুনতে পায়। এ দুটি দল কি কখনো সমান বলে
গন্য হতে পারে?
তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবেনা?” আল-কুরআন,
সূরা হুদ : ২৪।
এই আয়াতে উপমা
সহকারে প্রশ্নবোধক বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর ফলে দুটি দলের মধ্যে যে আকাশ পাতাল
ব্যবধান,
সেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে অতি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রশ্নের মাধ্যমে
নেতিবাচক উত্তর প্রকাশ আল-কুরআনের অন্যতম প্রকাশভঙ্গি। সূরা ফাজর এ ইরশাদ হচ্ছে ঃ
وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ
بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى
“আর সে দিন জাহান্নামকে
হাজির করা হবে এবং মানুষ স্মরণ করবে কিন্তু এ স্মরন তার কি কাজ দেবে ?” আল-কুরআন, সূরা ফাজর : ২৩।
এখানে যে বিষয়টি
পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে সেটা হলো মৃত্যুর পরে সতর্ক হলে বা আফসোস করলে কোন কাজ
হবে না। ছোট এই আয়াতটিকে সত্যিই আমাদের খুব গভীরভাবে গ্রহণ করা উচিৎ। যত সতর্কতা অবলম্বন
করা উচিৎ সেটা এ জীবনেই করতে হবে। মৃত্যুর পরে সতর্ক হলে বা অনুতপ্ত হলে সেটা কোনই
কাজে আসবে না।
ঙ) অবজ্ঞা প্রকাশ
কুরআনের কোন কোন
আয়াতে মানুষের প্রতি আলাহর কিছুটা বিরক্তি ভাব প্রকাশ পেয়েছে।
যেমন আলাহ বলেন -
قُتِلَ الْإِنْسَانُ مَا
أَكْفَرَهُ مِنْ أَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ مِنْ نُطْفَةٍ خَلَقَهُ فَقَدَّرَهُ
“মানুষের বিনাশ
হোক। সে কত অকৃতজ্ঞ! আলাহ তাকে কি জিনিস দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? শুক্র দিয়ে; তিনি তাকে সৃষ্টি
করেছেন,
এরপর তাকে পরিমিত করেছেন।” আল-কুরআন,
সূরা আবাসা : ১৭-১৯।
এখানে আলাহ তাআলা অনেকটা বিরক্তির সুরেই বলেছেন যে, মানুষ কি করে আলাহর অবাধ্য ও
অকৃতজ্ঞ হয় এবং কি করে মানুষ অহংকার ও দম্ভ প্রকাশ করে। কেননা এটা মানুষের শোভা পায়না।
চ) আশ্চার্যবোধক বাক্য ঃ
আল কুরআনে প্রচুর
পরিমান আশ্চার্যবোধক বাক্য পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে আসল কথাটি মানুষের কাছে আলাহ তা’আলা পরিষ্কারভাবে তুলে
ধরেছেন। আলাহ তা’আলা বলেন -
وَلَوْ أَنَّهُمْ آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَمَثُوبَةٌ مِنْ عِنْدِ
اللَّهِ خَيْرٌ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
“যদি তারা ঈমান
আনত ও মুত্তাকী হতো,
তাহলে তারা আলাহর কাছে এর জন্য
উত্তম পারিশ্রমিক পেত। হায় তারা যদি জানত!”
আল-কুরআন, সূরা বাকারা : ১০৩।
এই আয়াতে পরহিজগার
হওয়ার মূল্য কত,
ঈমানদার হলে কি পরিমাণ আলাহর রহমত পুরষ্কার লাভ করা যাবে। এখানে হায়! তারা যদি জানত। এই শব্দ কয়টির দ্বারা
বিষয়টির গভীরতা অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সূরা যুমার এ আলাহ বলেন ঃ
فَأَذَاقَهُمُ اللَّهُ
الْخِزْيَ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآَخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ
“সুতরাং আলাহ তাদেরকে পার্থিব জীবনেই অপমানের স্বাদ আস্বাদন করালেন, আর আখিরাতের আযাব তো বড়ই কঠিন। হায়! যদি তারা জানত!” আল-কুরআন, সূরা যুমার : ২৬।
এখানেও আমরা দেখতে
পারছি হা! যদি তারা জানত! বিষয় প্রকাশের ভঙ্গিটি। সত্যি এই প্রকাশভঙ্গির কারণেই বুদ্ধিমানরা
বুঝতে পারবে জাহান্নামের আজাব এর কঠোরতা ও কঠিনত্ব।
২) তেলাওয়াত ও সূরের মূর্ছনা
পৃথিবীর সর্বাধিক
পঠিত গ্রন্থ আল-কুরআন। সুরের মূর্ছনা ও তেলাওয়াত আল- কুরআনের শ্রেষ্ঠ মু‘জিযা। এ. জে. আরবেরি নামের একজন ইংরেজ তার কুরআনের ইংরেজি অনুবাদের
ভূমিকায় বলেছেন ঃ “যখনই আমি কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করি তখনই মনে মনে আমি এমন এক
অতলান্ত অনাবিল সঙ্গীত শুনতে পাই যার গভীরে আছে অব্যাহত সুর মূর্ছনা, মনে যেন একটি ড্রামের তালে আমার নিজেরই হৃদপিন্ডের ধুক ধুক শব্দ
শুনতে পাচ্ছি।
আর এক ইংরেজ মরামাডিউক
পিকথল। আল-কুরআনের তিনিও ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। সেই অনুদিত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন
ঃ “সেই অনুকরনীয় সুর ঝংকার ও শব্দলহরী মানুষকে এতখানি আবেগে আপ্লুত
করে ফেলে তখন সে আনন্দে অশ্র“ ধরে রাখতে পারে না।” এই লেখক আল-কুরআন অনুবাদ করার পূর্বে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন।
আমরা জানি না তিনি এই মন্তব্য ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে না পরে করেছিলেন।
আল কুরআনে সুরের
মূর্ছনা আছে এবং তার কিছু প্রকার ও ধরন আছে। যা ব্যাখ্যা বিশ্লেষনে সহায়ক ভূমিকা পালন
করে। যেহেতু সমস্ত কুরআনই ছন্দবদ্ধ সেহেতু সর্বত্রই সুর ও তাল বিদ্যমান। মানুষ যখন
কুরআন তেলাওয়াত করে তখন বাহ্যিক উচ্চারণে ছন্দ ও সুর পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে এই ব্যাপারটা
ছোট ছোট আয়াত সম্বলিত সূরা গুলোতেই দৃষ্টি গোচর হয়। নিচে কয়েকটি আয়াত উলেখ করা হলো। যেখানে সুর, ছন্দ ও মাত্রার
পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে ঃ
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى مَا
ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى وَمَا يَنْطِقُ
عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ
يُوحَى عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى ثُمَّ دَنَا
فَتَدَلَّى
“নক্ষত্রের কসম, যখন তা অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট কিংবা বিপথগামী হয়নি।
এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় ও কথা বলে না। কুরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। তাকে শিক্ষাদান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা। সহজাত শক্তি সম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেলো উর্ধ্ব দিগন্তে।” আল-কুরআন, সূরা আন নাজম : ১-৮।
فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ
أَدْنَى فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى
“অতঃপর নিকটবর্তী
হলো এবং ঝুলে রইল,
তখন ব্যবধান ছিলো দুই ধুনক কিংবা তার চেয়ে কম। তখন আলাহ তার বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার, তা প্রত্যাদেশ করলেন। রাসূলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে।
তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে?” আল-কুরআন,
সূরা আন নাজম : ৯-১২।
. أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ
وَالْعُزَّى وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى
“তোমরা কি ভেবে
দেখেছ লাত ও উজ্জা সম্পের্কে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?” আল-কুরআন, সূরা আন নাজম : ১৯-২০।
أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ
الْأُنْثَى
“পুত্র সন্তান
কি তোমাদের জন্য আর কন্যা সন্তান আলাহর জন্য?” আল-কুরআন, সূরা আন নাজম : ২১।
উলেখিত আয়াতগুলোতে শেষাক্ষরে একটি মিল আছে। কিন্তু আরবী ছন্দের
ধরনের চেয়ে তা কিছুটা ভিন্ন। সব আয়াতের শেষেই মিত্রাক্ষর এক ধরনের। ছন্দ ও মিত্রাক্ষরের
বদৌলতে প্রতিটি আয়াতের সাথে অপর আয়াতের একটি মিল সংঘটিত হয়েছে। ফলে বিচ্ছুরণ ঘটেছে
অপূর্ব সুর মূর্ছনার।
উলেখিত আয়াতগুলো ছোট ছোট বিধায় তা থেকে সৃষ্ট সুর মূর্ছনার স্থায়ীত্ব
খুব দীর্ঘ নয়। তবে সব আয়াতের সুর ও তালের মাত্রা এক। সাইয়্যেদ কুতুব, ভাষান্তর : মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মুমিন,আল কুরআনের শিল্প ও সৌন্দর্য্য, প্রথম সংস্করণ (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী) পৃ. ১৩১।
এমনিভাবে নিচের
কয়েকটি আয়াতে ‘ইয়া’
কে বিলুপ্ত করা হয়েছে ঃ
وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ
وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ هَلْ فِي ذَلِكَ قَسَمٌ لِذِي
حِجْرٍ
“শপথ ফজরের, শপথ দশ রাতের, শপথ তার যা জোড়
ও বিজোড় এবং শপথ রাতের যখন তা গত হয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে শপথ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য।” আল-কুরআন, সূরা ফজর : ১-৫।
উলেখিত আয়াতে ‘ইয়াসরী’ শব্দের ‘ইয়া’ কে বিলুপ্ত করা হয়েছে, যাতে ‘আল ফাজরি’ ‘আশরীন’ ‘ওয়াল বিতরি’ ইত্যাদি শব্দসমূহের
সাথে মিল থাকে।
অনুরূপভাবে যদি
নিচের আয়াতগুলো থেকে আসল ‘ইয়া’
এবং উত্তম পুরুষের ‘ইয়া’ এর শেষ থেকে ‘হা’ কে বিলোপ করা হয় তবে অবশ্যই ছন্দপতন ঘটবে।
وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ
مَوَازِينُهُ فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ نَارٌ حَامِيَةٌ
“আর যার পালা হাল্কা হবে, তার ঠিকানা হাবিয়াহ।
তুমি কি জানো তা কি?
তা হচ্ছে জলন্ত আগুন।” আল-কুরআন, সূরা আল ক্বারিয়াহ : ৮-১১।
ذِكْرُ رَحْمَةِ رَبِّكَ
عَبْدَهُ زَكَرِيَّا إِذْ نَادَى رَبَّهُ نِدَاءً خَفِيًّا قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ
الْعَظْمُ مِنِّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ
شَقِيًّا
“এটি তোমার প্রতিপালকের
অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন সে তাঁর পালনকর্তাকে নিভৃতে আহবান
করেছিলো এবং বলেছিলো,
হে আমার রব! আমার অস্থি বয়স ভারাবনত হয়েছে। বার্ধক্যে মাথা সুশুভ্র
হয়েছে কিন্তু আপনাকে ডেকে কখনো বিফলমনোরথ হইনি।” আল-কুরআন,
সূরা মারইয়াম : ২-৪।
উক্ত আয়াত দ্বয়ের
ভেতরস্থ সুর ও ছন্দ এতো সূ²,
যা শুধু অনুধাবন করা যায় কিন্তু ব্যক্ত করা যায় না। এধরনের সুর
ও তাল একক শব্দ সমষ্টি কিংবা একই বাক্যের বিন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা অনুধাবন করতে
হলে একমাত্র আলাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে সম্ভব, অন্য কোনভাবে নয়। তা এতোটা সূ² ও স্পর্শকাতর যে, তাতে সামান্য
একটু হেরফের হলেই সুর ও ছন্দের পতন ঘটে যায়।
আল কুরআনে প্রচুর
উপমা ও চিত্র ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উপমাগুলো এত সুন্দরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে সাধারণ
জ্ঞানের লোকও বিষয়টি সমন্ধে ভালভাবে বুঝতে পারে। নিচে কুরআনের কয়েকটি উপমা দেয়া হলো
ঃ
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ
اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ
وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا
وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍ كَشَجَرَةٍ
خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ
“আপনি কি দেখেননি
আলাহ কিভাবে আল বাণীর উপমা বর্ণনা করেছেন ঃ আল বাণী যেন এমন একটি
বৃক্ষ,
যার মূল মজবুতভবে কায়েম রয়েছে। আর তার শাখাগুলো আসমানে ছড়িয়ে
রয়েছে। তার ফল সব সময়ে দিতে থাকে তারই পালনকর্তার হুকুমে। আর আলাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করতে
পারে। আর অআল কথা যেন নাতা’আলা বৃক্ষের মতই যা মাটির উপর হতে উপড়ে ফেলা হেেছ, যান কোন স্থিতি নেই।” আল-কুরআন, সূরা ইবরাহীম : ২৪-২৬।
এটা এখন আমাদের
কাছে সুস্পষ্ট যে মানবকূলকে সহজ ও সুস্পষ্টভাবে কুরআনের মর্মবাণী বুঝিয়ে দেয়ার জন্য
উপমাগুলো যথেষ্ট সহায়ক। সূরা আনকাবুতে আরেকটি উপমা লক্ষ্য করা যায় ঃ
مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا
مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا
وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
“যারা আলাহকে বাদ দিয়ে আর কাউকে নিজেদের সাহায্যকারী হিসাবে মেনে নিয়েছে, তাদের উপমা তো ঠিক মাকড়সার মতই; যেন একটা মাকড়াসা ঘর বানিয়ে নিল। অথচ সবচাইতে অকেজো ঘর হচ্ছে
মাকড়াসার বাসা,
ওরা যদি বুঝতেই পারত।” আল-কুরআন, সূরা আনকাবুত : ৪১।
এমনিভাবে অতি
সাধারণ উপমার সাহায্যে সূরা ইবরাহীমে বক্তব্য পেশ করা হয়েছেঃ
مَثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا
بِرَبِّهِمْ أَعْمَالُهُمْ كَرَمَادٍ اشْتَدَّتْ بِهِ الرِّيحُ فِي يَوْمٍ عَاصِفٍ
لَا يَقْدِرُونَ مِمَّا كَسَبُوا عَلَى شَيْءٍ ذَلِكَ هُوَ الضَّلَالُ الْبَعِيدُ
“যারা নিজেদের
পালনকর্তার অবাধ্য হয়েছে,
তাদের কাজ কর্মের উপমা হচ্ছে ছাইয়ের মত। ঝড় বাদলের দিনে জোরদার
হাওয়া এসে তা উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর তারা যা কিছু কামাই করেছে সে সবের উপরে তাদের কোন
দখল থাকবেনা। এই তো হচ্ছে চরম গোমরাহী।” আল-কুরআন, সূরা ইবরাহীম : ১৮।
এখানে ছাইয়ের মত তুচ্ছ একটা জিনিসের উপমা তাদের হয়েছে মানুষের সব সম্পত্তি ও
শক্তির অসারতা বুঝানোর জন্য।
সূরা লুকমানে
গাধা দিয়ে একটি উপমা আমরা লক্ষ্য করি। যেখানে বলা হয়েছে ঃ
وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ
وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ
“আর তুমি মাঝামাঝি
ধরনে চলাফেরা করবে এবং তোমার গলার স্বর নিচু করবে। নিশ্চয়ই সবচাইতে জঘন্য আওয়াজ হচ্ছে
গাধার স্বর।”
আল-কুরআন, সূরা লুকমান : ১৯। গাধার
স্বর বড় কর্কশ,
বিকট ও বিদঘুটে। অনেকে তো ব্যঙ্গ করে বলে ‘গাধার গান’। গাধার নির্বুদ্ধিতা, বোকামি ও অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে নানা দেশে নানা গল্প কাহিনী রচিত
হয়েছে। গাধার নির্বুদ্ধিতা তাই সর্বকালে সবার কাছে পরিচিত বলে মনে হয়। দিদারুল ইসলাম, কুরআনের প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা অলংকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২০।
১৩) অতি উন্নত অলংকার শাস্ত্র
আল-কুরআন অভিনব
অলংকার শাস্ত্র। অন্য কোন গ্রন্থের সাথে এর তুলনা হয় না। কুরআনে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ
ভাষা অলংকার এসেছে নিতান্ত প্রয়োজনে। শোভা বর্ধনের জন্য নয়। বর্ণনা ও বক্তব্যকে অর্থবহ
ও বোধগম্য করার জন্যই এসব ভাষা অলংকার আপনা আপনি এসেছে। যেমন রূপক। উপমার কাছাকাছি
একটা ভাষা অলংকার। দুটি জিনিষের তুলনা বুঝাতে এর ব্যবহার। আক্ষরিক অর্থে যা বুঝা যায়
তার চেয়েও বেশী অর্থ বহন করতে আসে।
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ
عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آَيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ
مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا
تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ
تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آَمَنَّا
بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ
“তিনি আপনার প্রতি
কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তন্মধ্যেকার
রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আলাহ ব্যতিত কেউ
জানেনা। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেন, আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে
অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহন করেনা।” আল-কুরআন, সূরা আল ইমরান : ৭।
সূরা বাকারায়
বলা হয়েছে ঃ
أُولَئِكَ الَّذِينَ
اشْتَرَوُا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآَخِرَةِ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ
وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ
“এরাইতো সেই দল
যারা এই দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের বিনিময়ে খরিদ করেছে। সুতরাং তাদের আযাব বা শাস্তি
মোটেই হাল্কা করা হবেনা। কোন প্রকার সাহায্য তারা পাবেনা।” আল-কুরআন, সূরা বাকারা : ৮৬।
‘দুনিয়ার জীবনকে
আখিরাতের বিনিময়ে কিনা’
এখানে ক্রয় বিক্রয় কথাতে দুনিয়া ও আখিরাত ব্যবহৃত হয়েছে। দুনিয়া
কম দামী তার কাছে অনন্তকাল,
আরাম আয়েশের প্রগাঢ়তা হারানো অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। তাই উপমাটির
বিশাল ব্যবধান ব্যবহার সার্থক হয়েছে। সাইয়েদ কুতুব (র) বলেন ঃ
১. অলংকার শাস্ত্র বিদগণ কুরআনের বিন্যাসের অলংকারিক
যে সব দিক আলোচনা করেছেন- আয়াতের শেষে অথবা বক্তব্যের শেষে উপসংহার পদ্ধতি। যেমন-
(ক) আলাহর যাত ও সিফাত বর্ণনা শেষে,
(খ) রহস্য সম্পর্কে
আলোচনা শেষে,
(গ) প্রথমে اسم موصول সংযোজিত পদ নিয়ে তারপর ছিলাই সংযোজক ছাড়াই বাক্য পূর্ণ করা তারপর জাযা/প্রতিফল
বর্ণনা।
যেমন-
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا
بِآَيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ
وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ
“যারা আমার আয়াতকে
মিথ্যা বলেছে এবং অহংকার করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের আসমানের দরজা সমূহ খোলা হবে না
এবং তারা জান্নাতেও যেতে পারবে না, যতক্ষণ সূচের
ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করতে না পারবে।” আল-কুরআন, সূরা আরাফ : ৪০।
(ঘ) তালিম তারবিয়াত আলোচনা শেষে “রব” শব্দ;
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ
الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ
“পড়ো তোমার প্রভূর
নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ো তোমার
রব অত্যন্ত দয়ালু/সম্মানিত।” আল-কুরআন, সূরা আলাক : ১-৩।
(ঙ) আলাহর সার্বভৌমত্ব ও সম্মান প্রতিপত্তি আলোচনা শেষে;
إِنَّ اللَّهَ
عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي
الْأَرْحَامِ
“নিশ্চয়ই আলাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ের
যা থাকে তিনি তা জানেন।”
আল-কুরআন, সূরা লোকমান : ৩৪।
এমনিভাবে اللَّهَ শব্দটি স্থান ও কাল ভেদে বিভিন্নভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কখনো বাক্যের প্রথমে اللَّهَপরে সর্বনাম, কোথাও বাক্যের
শুরুতে আবার শেষে,
কোথাও যৌথ ব্যবহার।
(৪) অনেক সময় কুরআনের
বিভিন্ন আয়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ধারাবাহিকতা থাকে। একটির উদ্দেশ্যকে অন্যটির উদ্দেশ্যে
পরিবর্তন করার ফলে যে সম্পর্ক তা ও শৈল্পিক বিন্যাস। অবশ্য কুরআন প্রচলিত অলংকার শাস্ত্রের
পদ্ধতি থেকে মুক্ত।
(৫) বিন্যাস কৌশল
ও তার প্রকৃতি- (যা কিছু আয়াতের বর্ণনা পরম্পরার) অলংকার শাস্ত্র বিদগণ সূরা ফাতিহার
আলামা যামাখশরী (র) এর লেখা থেকে “আল কুরআনের গবেষণা ও তাফসীর” অধ্যায়ে এনেছেন। যেখানে কুরআনের সুর-ছন্দ শৈল্পিক বিন্যাসের উত্তম প্রকাশ দৃষ্টির
আড়ালে থাকতেই পরিতৃপ্ত। নতুন গবেষণা ও উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রন্থটি আল কুরআনের শিল্প ও সৌন্দর্য
এর অবতারণা।
১৪) শৈল্পিক বিন্যাস ও রচনাশৈলী
কাব্যিক গুণগত
দিক থেকে আল কুরআন এক অলৌকিক মহাগ্রন্থ। বিশ্ব সাহিত্যে এক অতুলনীয় মহাসম্পদ। এর বাক্য
নির্মাণে,
শব্দ প্রয়োগে, সুরে ছন্দে, ভাষা রূপ, চিত্র কল্প নির্মাণে
রয়েছে এক বিস্ময়কর লালিত্য মাধুর্য, যা প্রাণের তারে
তারে,
মনের পরতে পরতে, অনুভূতির গভীরে, মর্মমূলের কন্দরে কন্দরে পুলক শিহরণ জাগায়। যাতে শিল্পকলার দৃষ্টিতে
সামান্যতম ভুল বা অসঙ্গতি নেই। এ দিক থেকে বিচার করলে কুরআন এক নজিরবিহীন মু‘জিযা। আজ পর্যন্ত বিশ্বের কবিকুল এমন একটি গ্রন্থ রচনা করা তো
দূরের কথা,
একটি সূরা কিংবা একটি আয়াতও রচনা করতে পারেনি।
বিন্যাসের শৈল্পিক
ও অলংকারিক কতিপয় দিক আছে;
যে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ বিশ্লেষণ করেছেন। কিছু দিকে স্পর্শ পর্যন্তও
পড়েনি।
২. শৈল্পিক বিন্যাসের একটি হচ্ছে- যা ইবাদাতের অবস্থা
ও ধরণের পথে সংশ্লিষ্ট। যেমন- উপযোগী কিছু শব্দ চয়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বিন্যাস
করা। যার বদৌলতে সে বাক্য বা কথা পূর্ণতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যায়।
৩. সুর ও ছন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট। বাক্যান্তে শব্দগুলো
এমনভাবে সন্নিবেশিত,
তাল (জুঃযস) ও মাত্রা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর মান অতি
উচ্চে,
যেখানে কুরআন ছাড়া কারো প্রবেশাধিকার নেই। আলেমগণ এ বিষয়ে বেশী
অবহিত না থাকায় এ বিভাগে গবেষণা কম হয়েছে।
৪. কুরআনের ভাষাগত চমৎকারীত্ব পাঠককে প্রবল ভাবে
মুগ্ধ ও অভিভূত করে দেয়। আইন সংক্রান্ত আয়াতের ভাষাগত বিন্যাসে ও শব্দ চয়নে যে অলৌকিক
নৈপুন্য,
অলঙ্কারীক চমৎকারীত্ব এখানে প্রদর্শিত হয়েছে, তা মানবীয় সাহিত্যের গন্ডিতে কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। এ বাচনভঙ্গির
পারিভাষিক নামই হলো “এজাযুল কুরআন” (কুরআনের অপরাগকরণ)। আইনগত বিধি-বিধান সম্পর্কিত আয়াত গুলোতে এ এ‘জায আরো স্পষ্ট ও শাণিত হয়ে উঠেছে। এখানকার বক্তব্য সূ² ও নিপুণ যে একটা শব্দের হেরফের হলেই তা পাল্টে যেত এবং তার
বিকল্প থাকতো না। স্বয়ং আলাহতা‘আলা যদি এজাযকে সংরক্ষণ
না করতেন তাহলে কুরআনের আইনগত শব্দবচন ও শব্দ বিন্যাস এবং ভাষাগত সৌন্দর্য দুটোই পূর্ণমাত্রায়
এমন নজিরবিহীন ভাবে প্রতিফলিত হতে পারতো না। সাইয়্যেদ কুতুব, বিস্ময়কর গ্রন্থ আল-কুরআন, প্রাগুক্ত,
পৃ. ৫৪।
৫. আল-কুরআনের শব্দ চয়নে অভূতপূর্ব রীতি গ্রহণ করা
হয়েছে। যা মানবীয় শক্তি-সামর্থের বাইরে। যেমন কিছু শব্দ কুরআনে বহুবচন ব্যবহৃত। উদাহরণ
স্বরুপ اللب তার একবচনের রূপ নেই। একবচন এর স্থলে সমর্থক الباب এসেছে। অনুরুপভাবে الكواكب.বহুবচন অপরদিকে الرضএকবচন ব্যবহৃত। এটিও মু‘জিযা। কুরআনে গাম্ভীর্যপূর্ণ শব্দ, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, সাবলীল ভাষা ও
সংগতিপূর্ণভাব আলাহর বাণী ছাড়া মানুষের বক্তব্যে, লিখনীতে এ বৈশিষ্ট অসম্ভব। সূরা কাওসারের ৩টি আয়াতে প্রতিটি
শব্দের গাম্ভীর্যতার সাথে দুটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।
৬. কুরআন মাজীদের অভিনব নাজম বা রচনা শৈলী আরবদের
রচনা শৈলী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এটি কোন গদ্যও নয় এবং পদ্যও নয়। এ প্রসংগে কুরাইশদের
অন্যতম ভাষাবিদ,
অলংকার ও কাব্য শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ওয়ালীদ ইবন মুগীরার উক্তি একটি
বড় প্রমাণ। ইমাম বায়হাকী (রঃ) তার দালাইলুন নবুওয়াত গ্রন্থে ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ওলীদ ইবন মুগীরা একদিন নবী করীম (সা.) এর নিকট আগমন করেন। তখন
রাসূলুলাহ (সা.) তাকে কুরআন মাজীদ পড়ে শুনান। এতে তিনি কিছুটা বিগলিত
হয়ে পড়েন। এ খবর আবু জাহালের নিকট পৌঁছে। তখন সে তার (ওলীদের) নিকট গিয়ে বলে, হে চাচা আপনার স¤প্রদায় আপনার
জন্য সম্পদ সংগ্রহ করে তা আপনাকে প্রদান করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। কেননা আপনি মুহাম্মদ
(সা.) এর নিকট গমন করেছেন এবং তার উপস্থাপিত বস্তু থেকে উপকৃত হতে চাচ্ছেন। তখন তিনি
বলেন,
কুরায়শরা জানে, আমি তাদের মধ্যে
সর্বাধিক সম্পদের অধিকারী। তখন আবু জাহাল বলল, তাহলে আপনি তার
(মুহাম্মদ) সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য করুন যা শুনে আপনার স¤প্রদায় বুঝতে পারে যে, আপনি তাকে অস্বীকার
করেন। তিনি তখন বলেন,
আমি কি বলব? আলাহর শপথ তোমাদের মধ্যে কবিতা সম্পর্কে আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানের
অধিকারী কেউ নেই। সে কবিতা রাজয (এক প্রকার ছন্দবদ্ধ আরবী কবিতা) হোক বা কাসীদা হউক
বা জিনদের কবিতা হউক। আলাহর শপথ! সে যা বলেছে তাতে রয়েছে এক অপূূর্ব মাধুর্য এবং এর
বিন্যাসে রয়েছে এক স্নিগ্ধ ফলগুধারা। এটা নিশ্চয়ই সবার উর্ধ্বে থাকবে। এর ওপর কেউ প্রবল
হতে পারবে না। তখন আবু জাহলো বলল, আলাহর কসম তার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা ছাড়া আপনার জাতি আপনার
প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। তখন তিনি বললেন, আমাকে চিন্তা
ভাবনা করার জন্য সময় দিন। চিন্তা-ভাবনার পর তিনি বললেন, ‘এতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত জাদু বৈ কিছুই নয়। তার এ মন্তব্যের
পর আলাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের আয়াত
নাজিল করেন। যার অর্থ এই, “যাকে আমি অনন্য করে সৃষ্টি
করেছি,
তাকে আমার হাতে ছেড়ে দিন। আমি তাকে বিপুল ধন-সম্পদ দিয়েছি এবং
মদাসঙ্গী পুত্রবর্গ দিয়েছি। আর তাকে খুব সচ্ছলতা দিয়েছি। এরপর সে আশা করে যে, আমি তাকে আরও বেশি দেই।
কখনই নয়। সে আমার নিদর্শন সমূহের বিরুদ্ধচারনকারী। আমি সত্ত¡রই তাকে শাস্তির পাহাড়ে আরোহন করাব। সে চিন্তা করেছে এবং মনস্থির
করেছে ও মূখ বিকৃত করেছে। অতঃপর পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে ও অহংকার করেছে। এরপর বলেছে, এতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত জাদু বৈ কিছুই নয়।”
উপরের ঘটনা থেকে
স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে,
‘আরবের পন্ডিত ও ভাষাবিদরা কুরআনের রচনা শৈলী দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় এবং অকপটে এর এজাযকে স্বীকার
করে। এমনকি পরিস্কার মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকে। অতঃপর চিন্তা ভাবনা করে তাকে জাদু
বলে আখ্যায়িত করে। মুহাম্মাদ আলী সাবূনী ‘আততিবইয়ান ফি
উলুমিল কুরআন’
প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৫-১০৬।
চলবে
লেখক: বহুগ্রন্থ প্রণেতা
ইমাম মাওলানা এম. নুরুর রহমান
সেক্রেটারি:
শারীয়া কাউন্সিল ব্যাডফোরড ও মিডল্যনড ইউ কে-
ইমাম ও খাতিব:
মাসজিদুল উম্মাহ লুটন ইউ কে
সত্যয়ান কারী চেয়ারম্যন:
নিকাহ নামা সার্টিফিকেট ইউ কে
প্রিন্সিপাল:
আর রাহমান একাডেমি ইউ কে
পরিচালক:
আর-রাহমান এডুকেশন ট্রাস্ট ইউ কে
📞07476136772 📞 07476 961067
nrahmansky@googlemail.com
Arrahmaneducationtust@gmail.com
https://www.facebook.com/Imam.Nurur
https://www.facebook.com/ARET.OR.UK/
https://www.youtube.com/user/nurur9
0 coment rios:
You can comment here