।। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল।।
মানবজীবনে প্রতারণার
মাধ্যমে অন্যের অধিকার দারুণভাবে খর্ব হয়। নৈতিক, ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়। সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মানুষের নেক
আমলকে ধ্বংস করে এবং তাকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। অথচ সমাজের সর্বত্রই মানুষের
কথাবার্তায়,
কাজকর্মে লেনদেনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিদেশ গমনে এমনকি হজযাত্রায়ও ট্রাভেল এজেন্সির বিভিন্নভাবে প্রতারণার
অপপ্রয়াস চলছে।
ইসলামে ধোঁকা ও প্রতারণার কোনো স্থান নেই। কোনো মুসলমান ধোঁকা দিতে পারে না। ধোঁকা মুনাফেকের স্বভাব। মহান সৃষ্টিকর্তা কুরআনে প্রতারণার জন্য কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় মুনাফেকরা মুখে বলতো আমরা আল্লাহকে, আল্লাহর নবীকে এবং এই কুরআনকে মানি কিন্তু তারা বাস্তবে তা মানতো না। যার ফলে সৃষ্টিকর্তা এই আয়াত নাজিল করেন : ‘এমন কিছু লোক আছে যারা বলে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে এবং শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস করি। প্রকৃতপক্ষে তারা বিশ্বাস করেনি, তারা সৃষ্টিকর্তাকে ও বিশ্বাসী ব্যক্তিদেরকে ধোঁকা দিতে চায়। (সত্য কথা এই যে) তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। এবং তদের এই বিষয়ে কোনো উপলব্ধি নেই।’ (সুরা বাকারা : ৮-৯)
অন্য এক আয়াতে
এসেছে,
‘তারা যদি তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তবে সৃষ্টিকর্তাই তোমার জন্য যথেষ্ট। তিনিই নিজ সাহায্যে বিশ^াসীর দ্বারা তোমাকে শক্তিশালী করেছেন।’ (সুরা আনফাল : ৬২)
বর্ণিত আয়াতসমূহে
সৃষ্টিকর্তা ধোঁকাবাজদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তারা মুখের
কথার মাধ্যমে মহান স্রষ্টা ও বিশ্বাসী ব্যক্তিকে ধোঁকা দিতে
চায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাই ধোঁকার শিকার হয়েছে। কেননা, এ ধোঁকার পরিণাম তাদের জন্য অশুভ হবে। তারা মনে করছে নিজেদেরকে
মুসলিম পরিচয় দিয়ে তারা কুফরের পার্থিব পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। অথচ শেষ দিবসে তাদের
জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। নবী (সা.) ধোঁকা ও প্রতারণাকারী সম্পর্কে কঠোর বাক্য
উচ্চারণ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ধোঁকাবাজ ও প্রতারণাকারী
জাহান্নামে যাবে। (বায়হাকী)
বস্তুত যারা মহান
স্রষ্টা,
নবী (সা.) ও বিশ্বাসীদের ধোঁকা দেবে তারাই কঠিন শাস্তির সম্মুখীন
হবে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস লালন করা ও সে অনুযায়ী আমল করা।
তাহলেই সে প্রকৃত বিশ্বাসী হতে পারবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুখে এক কথা আর অন্তরে আর এক কথায়- এটা কোনো বিশ্বাসীর কাজ হতে পারে না। তার বৈশিষ্ট্যই হলো সে
কখনও ধোঁকা দেবে না এবং ধোঁকার শিকার হবে না। যুগে যুগে ধোঁকাবাজ ছিল, এখনও আছে। কিন্তু ইচ্ছে করে কারো সঙ্গে ধোঁকাবাজি করা যাবে
না,
এমনকি ঠাট্টাচ্ছলেও না।
সমাজের কিছু লোক
আছেন,
যারা সামর্থ্য থাকা সত্বেও পাওনাদারকে ঠকানোর মনোবৃত্তি নিয়েই
ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করেন। যা প্রত্যাশিত আচরণ নয়। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে অনন্তকালে তার
সৎকাজ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। না হলে পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যেতে হবে।
ঋণ নিয়ে উচ্চাভিলাষ চরিতার্থকারী ঋণখেলাপির জানাজা রাসুলুল্লাহ (সা.) পড়তেন না।
তবে ঋণ পরিশোধের
প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও অপারগতাবশত সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারে না, এ ধরনের ঋণখেলাপিকে অবকাশ দিয়েছে ইসলাম। অনিবার্য কারণে ঋণ পরিশোধে
অপারগতা দেখা দিলে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। নির্ধারিত সময়ের আগেই অবহিত
করতে হবে ঋণদাতাকে। সেই ঋণ পরিশোধের চেষ্টা থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে পার্থিব প্রচেষ্টার
পাশাপাশি স্রষ্টার কাছে সাহায্য কামনা করতে হবে। তিরিমিজি শরীফের এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে
: একবার আলী (রা.)-এর কাছে এক ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধের জন্য কিছু সাহায্য চাইলেন। এ
সময় আলী (রা.) তাকে বললেন,
আমি কি তোমাকে কয়েকটি শব্দ শিক্ষা দেব না, যা আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন? যদি তুমি এটা পড় তাহলে স্রষ্টাই তোমার ঋণমুক্তির ব্যাপারে দায়িত্ব
নিবেন। যদি তোমার ঋণ পর্বতসমানও হয়।
এরপর আলী (রা.)
ওই ব্যক্তিকে বললেন পড় : ‘হে সৃষ্টিকর্তা! হারামের পরিবর্তে তোমার হালাল রুজি আমার জন্য
যথেষ্ট কর। আর তোমাকে ছাড়া আমাকে কারো মুখাপেক্ষী করো না এবং স্বীয় অনুগ্রহ দ্বারা
আমাকে স্বচ্ছলতা দান কর।’
ইসলামী স্কলারদের
অভিমত হলো,
দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে স্রষ্টার কাছে ঋণমুক্তির
জন্য সাহায্য কামনা করলে,
আশা করা যায় তিনি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সব ধরনের ঋণ থেকে মুক্ত
করবেন।
ধোঁকা দিয়ে যে
কোনো ধরণের সুবিধা নেওয়ার পথ ও পদ্ধতি ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। ইসলাম বিশেজ্ঞদের
অভিমত হলো,
ধোঁকা দিয়ে প্রচলিত আইন ভেঙে কোনো সুবিধা নেওয়াও ইসলামের এই
বিধানের অন্তর্ভুক্ত। কারণ,
এখানে ওই প্রতারকের ওপর আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ আরোপ করা হবে এবং
অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ওপর শাস্তি বর্তাবে।
ধোঁকা ও প্রতারণা
প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে,
হুযায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো বিশ্বাসীর জন্য
উচিত নয় নিজেকে অপমানিত করা। সাহাবারা বললেন, কিভাবে ব্যক্তি
নিজেকে অপমানিত করে?
তিনি বললেন, অনুচিত বিপদে
নিজেকে জড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)
যে সব লোক মিথ্যা
কথা বলে কোনো দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে কিংবা কোনো অফিস-আদালত থেকে সুবিধা নেয়- তা গ্রহণ
করা জায়েজ নয়। কারণ হারাম পন্থায় তা অর্জন করা হয়েছে। কেননা মিথ্যা বলা জায়েজ নয়, কাউকে ধোঁকা দেওয়া জায়েজ নয়। সুতরাং এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত
অর্থও জায়েজ নয়।
এ প্রসঙ্গে সৃষ্টিকর্তা
পবিত্র কুরআনে বলেন : ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা পরস্পরের সম্পদকে অন্যায়ভাবে গ্রাস করো
না,
তবে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে পারস্পরিক সন্তুষ্টচিত্তে হলে সেটা ভিন্ন
কথা।’ (সুরা আন নিসা : ২৯)
পবিত্র কুরআনে
আরও এসেছে : ‘তোমরা মূর্তিপূজার নোংরামী থেকে বাঁচো এবং মিথ্যা কথা থেকে বাঁচো।’ (সুরা হজ : ৩০)
আবু হুরায়রা
(রা.) থেকে বর্ণিত,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘যে আমার উম্মতের ওপর অস্ত্র উঁচু করে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়, আর যে আমাদের সাথে ধোঁকাবাজী করে সেও আমার উম্মতভুক্ত নয়।’ (সহীহ মুসলিম)
এ বিষয়ে একটি
প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে,
মিথ্যা ঘোষণা কিংবা তথ্য দিয়ে কোনো সুবিধা অথবা চাকুরি নেওয়ার
পর তাকে যদি কোনো হালাল কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়, আর সে কাজের বিনিময়ে তাদের বেতন দেওয়া হয়, তাহলে উক্ত কাজের
মজুরি হিসেবে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েজ হবে। যদিও চাকুরিতে যোগদানের পদ্ধতিটি জায়েজ ছিলো
না। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ৭/৩০০, ফাতাওযায়ে মাহমুদিয়া : ২৮/৩৭৫)
ধোঁকা দিয়ে সুবিদা
নিলে কিংবা মিথ্যা বলে চাকুরি নেওয়া লোকদের বিষয়ে আরেকটি মাসয়ালা হলো, ধোঁকা দিয়ে কিংবা মিথ্যা ঘোষণা ও তথ্য দিয়ে যে টাকা নিয়েছে
কিংবা যে সব সুবিধা গ্রহণ করেছে- সে সব যেহেতু না জায়েজ ছিলো, তাই সে টাকা অফিসে কিংবা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু
ওই ফিরিয়ে দিতে গেলে যদি কোনো বড় ধরনের ঝামেলায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে উক্ত পরিমাণ টাকা কোনো গরীবকে দান করে দিবে সওয়াবের নিয়ত
ছাড়া। আর ধোঁকাবাজী,
প্রতারণার পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করার কারণে মহান স্রষ্টার দরবারে
ক্ষমা চাইবে এবং ক্ষমা চাইবে।
তাই প্রত্যেক
বিশ্বাসীর প্রতিজ্ঞা দরকার আমরা যে সমাজে
বাস করি যেখানে সর্বত্রই ভেজালের ছড়াছড়ি। ধোঁকা প্রতারণার জাল বিস্তার করছে সর্বত্র।
কে কাকে ঠকাবে সে চিন্তায় অস্থির প্রায়। এ কথাগুলো অস্বীকার মতো নয়। কেউ অবিশ্বাস করতে
পারবে না এ বাস্তব সত্য। অথচ মুসলমানদের আদর্শ এটা নয়, আমাদের নবীজীর আদর্শ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বিশ্বাসী কখনো এক গর্তে দু’বার পা দেয় না।’ তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বাসী কাউকে ধোঁকা দেয় না ধোঁকা খায় না।’ ধোঁকা মুসলমানদের
আদর্শ নয়। চলমান সমাজকে যদি শান্তিময় ও সুখময় করতে হয়, যদি শান্তির অনাবিল নীড় গড়তে হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের ধোঁকা প্রতারণা ও ভেজাল ছাড়তে হবে। তাহলেই
সমাজ স্বচ্ছ,
সুন্দর ও কল্যাণময় হয়ে ওঠবে।
0 coment rios:
You can comment here