Saturday, October 10, 2020

মা-বাবা, বৃদ্ধাশ্রম ও আমি

 

 ।। মুন্সি আব্দুল কাদির।।

ভারতের উত্তর প্রদেশে স্বাধীনতা দিবসে এক মেয়ে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে নিজে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ পরে তল্যাশি চালিয়ে তার নিজের লেখা আঠার পৃষ্ঠার একটি চিঠি উদ্ধার করে। যা প্রধানমন্ত্রিকে উদ্দেশ্য করে লেখা। সে চেয়েছিল এটি প্রধানমন্ত্রির কাছে পৌঁছাতে। এই চিঠির সর্বশেষ কথা হল, “যে পৃথিবীতে মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এমন পৃথিবীতে আমি আর থাকতে চাই না। আত্মহত্যা অবশ্যই ভাল কাজ নয়। কিন্তু তার এই কথাটি সত্যি হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। এই ছোট্ট একটি কথায় চোখের কোনায় পানি চিক চিক করে উঠে। 

আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে অবহেলিত জনের নাম বৃদ্ধ মা বাবা। বলুনতো কোন সভ্য সমাজে বৃদ্ধাশ্রম নামে কোন কিছু থাকা কি স্বাভাবিক। হ্যা হতে পারে কোন মা বাবার ছেলে মেয়ে নেই। তাদেরকে দেখাশোনা করার জন্য একটি ব্যবস্থা থাকতে পারে বা থাকা উচিত। আজকের বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে কারা থাকেন। আমরা তথাকথিত সভ্য, না বন্য জানোয়ারেরা একটু সমস্যা মনে করলেই মা বাবাকে তাড়িয়ে দেই। তারা চলে গেলে যেন আমরা বেঁচে যাই। আমরা একবারও কি ভেবেছি, আমার আপনার বাবা মা, এমনকি যে কারো বাবা মা কোন দিন বলেছে বা ভেবেছে। আর পারছি না এই ছেলেটাকে শিশু আশ্রমে দিয়ে দেই। পৃথিবীতে আসার সময় সব শিশু সোনার চামচ মুখে দিয়ে আসে না। পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ অর্থ বিত্তশালী নয়। প্রত্যেক মা বাবা তার সন্তানকে কত ভালবাসেন। সব বিপদ, ধকল নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান। বাবা না থাকলে, কাম্ইা রোজগারের কেউ না থাকলে প্রয়োজনে মা ঝি এর কাজ করে হলেও সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন।

একটু ভাবুন তো এই পৃথিবীতে সব চেয়ে ছোট এবং প্রিয় নামটি আপনার কাছে কোনটি। আপনি যদি মা বাবাকে দেখতে না পারেন। তবে একটি কথা বলুন তো আপনি যখন কোথায় হোঁচট খান। হঠাৎ কোন কিছুর আঘাতে ব্যথা পান। আপনার মুখ দিয়ে অজান্তে কোন শব্দটি বের হয়ে আসে? একটু কি চিন্তা করেছেন? এই শব্দটির সাথে আপনার নাড়ির কত টান? আপনি অস্বীকার করতেই পারেন। একবার বুকে হাত দিয়ে বলুনতো। আপনি ব্যথা পেলে ওহ শব্দের সাথে আপনার মা ছাড়া, আপনার বউ, ছেলে মেয়ে কারো নাম কি কখনো বের হয়েছে। না বের হয় না। আসেই না। আপনার শৈশব কৈশোর কালটা একটু এক জ¦লক চোখ বুলিয়ে দেখুন। আপনি তাদের কত কষ্ট দিয়েছেন? দেখুন আপনার চোখের সামনে এক এক করে সেই চিত্র ভেসে উঠবে। এক এক করে চিত্র পাল্টাতে থাকুন। চোখ দিয়ে পানি না এসে পারবে না। যদি আপনি মানুষ হন। আর মনুষ্যত্ব কোথাও বন্ধক দিয়ে থাকলে আপনার চোখে কিছুই দেখবেন না। দেখুন বাবা ক্লান্ত হয়ে মাঠ থেকে, বাজার থেকে, অফিস থেকে বাসায় এসেছেন। এসেই আপনাকে খুঁজছেন। নিজের আরামের দিকে খেয়াল নেই। আপনাকে কাছে পেলে তার সব ক্লান্তি মুহুর্তে হাওয়া হয়ে যায়।

ধরুন আপনি নানার বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। কয়েকদিন বেড়াচ্ছেন। নানা নানী, মামা মামী খালাদের আদরে আপনি বাড়ির কথা ভুলে আছেন। বলুন আপনার মায়ের রাতের ঘুম কি খুব আরামের হয়েছে। আপনার মা বাবা এই আপনাকে ছাড়া কয়দিন থাকতে পেরেছেন, বলুন। একে একে মনের পর্দায় সবগুলো বিষয় নিয়ে আসুন। আপনার কত আবদার মা বাবা রক্ষা করেছেন। আপনি কোন কিছু চেয়েছেন, আর মা বাবার সাধ্য অনুযায়ী এনে দিতে চেষ্টা করেন নি। আপনি কি বলতে পারবেন? দেখুন আপনার ছেলে মেয়ে আপনার কাছে কোন কিছুর আবদার করলেআপনার যদি এনে দেওয়ার সামর্থ না থাকে আপনার কাছে কেমন লাগে? এই আপনি তো আপনার মা বাবার সন্তান, সেদিন তাদের অনুভুতি কেমন ছিল?

এই আপনি আমি খুব বেশী দেরী নেই ঠিক তাদের মত বৃদ্ধ হব, যদি হায়াতে বেঁচে থাকি। আপনার মা বাবার অবস্থাটা নিজে একবার ভাবুন তো। আপনি মুহূর্তেই কোথায় হারিয়ে যাবেন। একবার ভেবেই দেখুন না। আপনি দেখুন। এই মা বাবার কোন মূল্য কি দেওয়ার আপনার সাধ্য আছে। আপনার প্রিয় বউকে জিজ্ঞাসা করুন। পেটে সন্তানের ভার বহন করা, প্রসব ব্যথা, সন্তান ভুমিষ্ট হওয়ার কষ্ট একবার জেনে নিন। আপনার প্রিয় বউটিও তো সন্তানের মা। মা সব কষ্ট বলতে পারবে না। তারপরও তো অনেক ধারণা পাবেন। মায়ের এই কষ্টের মূল্য দেওয়ার সাধ্য কি আপনার আছে! আপনি মুরগীর বাচ্চার মত ছিলেন না, ছিলেন না গরুর বাছুর, না ছিলেন কোন কীট পতঙ্গের ছাও। যে আপনি আধ ঘন্টা বা এক ঘন্টা পর চলতে পেরেছেন। হাটতে পেরেছেন, খেতে পেরেছেন। এই আপনাকে হাটা শিখানো মায়ের কতটি মাস দিন পার হয়েছে। এই আপনাকে নিজ হাতে খানা শিখানো পর্যন্ত মায়ের কতটি বৎসর পার করতে হয়েছে। এই আপনাকে কথা বলা শিখাতে, কাপড় পড়া শিখাতে, আলাদা বিছানায় ঘুমানো শিখাতে মায়ের জীবন থেকে কতটি বছর শুধু আপনাকে এই আপনাকে দিয়েছেন। আপনাকে মানুষ করার জন্য তাদের কত কষ্ট, কত পেরেশানী, কত অর্থ কড়ি ব্যয়, আপনার দুষ্টামিকে সামাল দিতে গিয়ে কত জনের কথা শোনা। একবারও কি ভেবেছেন! হ্যাঁ ভাববেনইবা কেন, আপনার জন্য তাদের এতো কষ্ট আপনি সব সব ভুলে গেছেন। মনে মনে ভাবছেন আপনাকে বোধ হয় আদম আলাইহিস সালাম এর মত যৌবন প্রাপ্ত করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আপনি দুনিয়াতে এসেই বিবি হাওয়া আঃ এর সহজাত একজন নারী পেয়ে গেছেন। তাকে নিয়ে খুব আরামে দিন যাপন করছেন। ভাববেন না, আমি শুধু আপনাকে বলছি। আমিও আপনার কাতারে। হয়তো একটু পিছে এই আর কি।

এভাবে আপনি বড় হতে লাগলেন, আপনি বন্ধুদের সাথে খেলায় যেতে লাগলেন। এখানে সেখানে যেতে লাগলেন। মা সারাদিন আপনার চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত। আপনি কোথায়, কখন ফিরবেন। মায়ের হাতে সংসারের অনেক কাজ। আপনি যখন ছোট মা রান্না ঘরে রান্না করছেন। একটি কান সব সময় আপনার দিকে, আপনি এ্যা করতে দেরী মায়ের দৌঁড় দিতে দেরী নেই। আপনি রাতে প্রস্রাব করে কাথা ভিজিয়ে দিয়েছেন। শীতের রাত ঘরে ধরুন আর কাঁথা নেই। কয়েক বারে আপনি যে কয়টা ছিল ভিজিয়ে দিয়েছেন। ঐ যে দেখুন এই বৃদ্ধ মা টি ই আপনাকে শুকনো জায়গায় শুইয়ে নিজে ভিজা জায়গায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রিয় ভাই একটু ভাবুন। আপনার কান কি সেই ছোট কালে মায়ের আপনার দিকের মত, এখন মায়ের বাবার জন্য কান খাড়া থাকে!

আরো একটু চিন্তা করুন। আপনি কোথাও গিয়েছেন। উঠানে ধান রোদে শুকাচ্ছে। দুপুর হয়ে গেছে। মা এখনও রান্না করার সময় পাচেছন না। ও দিকে সময় চলে যাচ্ছে। মায়ের মধ্যে পেরেশানী আমার বাছাধন চলে আসবে। তার পেটে ক্ষুধা লেেেগছে। এসে যেন আপনি খেতে পারেন। ক্ষুধার কষ্ট না পান এই মা যেভাবে হোক, যত কষ্টই হোক রান্নায় চলে গেছেন। আপনি অসুস্থ, আপনার সাথে মাও রাত জেগে কাটাচ্ছেন। আপনি মাঝে মাঝে ঘুমাতে থাকেন। এই মা আপনার শিয়রে বসে থাকেন। দু হাত পেতে মাওলার কাছে চোখের পানি ফেলেন। আপনার ভাল, রোগ মুক্তির জন্য সাধ্য অনুযায়ী এমন কিছু নেই, চেষ্টা করেন না। হাতে টাকা নেই, ঋণ করে হলেও, মানুষের কাছে হাত পেতে হলেও এই আপনার চিকিৎসা করান। কি অস্বীকার করতে পারবেন? আমি জানি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। আমিও পারব না। বলুনতো এই বৃদ্ধ অসুস্থ মা বাবার জন্য কয় রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন? বলার সাহস কি আছে?

বলুনতো ভাই আপনার সুখের জন্য তারা তাদের সাধ্যাতীত কোন কাজটি করার চেষ্টা করেন নি? বলতে কি পারবেন? পারবেন না। কোন সন্তানই পারবে না। আপনার সুখের জন্য এখনও দুই ঠোঁটে কিছু বলেন না। বলুনতো আপনি চাকরি থেকে বাসায় আসলে আপনার ছেলে মেয়ে বউ, কত কিছু আবদার করে। জানতে চায় তার জন্য কি এনেছেন? একবার বলুনতো আপনার জন্য সারা জীবন কষ্ট করা এই বৃদ্ধ মা বাবা আপনার কাছে কখনও কি জিজ্ঞাসা করেছে যে বাবা আমার জন্য কি এনেছ। না করেন নি। যারা সারা জীবন দিয়েই যান। যেমন আজ আপনি আপনার সন্তানদের জন্য দিয়ে যাচেছন। তাদের জন্য আপনার আমার কি কোন কিছু করার নেই। তারা আজ বৃদ্ধাশ্রমে গেলে, কাল কিন্তু আপনাকে আমাকেও সেখানে যেতে হবে। তখন হয়তো তারা থাকবেন না। আমরাও তাদের মত মুখ গোঁজে কাঁদব। কেউ দেখার থাকবে না। তখন তাদেরকে খুব মিস করব। কিন্তু লাভ কি তাতে? বলুন তো ভাই আপনি কোথাও গেলে এখনও কে আপনার পথের দিকে চেয়ে থাকে? কি মনে কোন উত্তর উঁকি দেয় না। না আপনি নিজেকে লুকানোর জন্য আটকে রেখেছেন। ভাই আটকে রাখতে পারেন। একদিন কিন্তু লোক চক্ষুর অন্তরালে হলেও মুখ গোঁজে কাঁদবেন। আর সেই ক্ষণ টি খুব দূরে নয়। আজ আপনি চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি করছেন। এর কৃতিত্ব কাকে দেবেন। নিজেকে, না মা বাবাকে। যারা আপনাকে গড়ে উঠার জন্য রাত দিন পরিশ্রম আর দোয়া করেছেন। আজ বলুন তো ভাই তাদের কল্যাণের জন্য কয় ফোঁটা চোখের পানি আপনি ফেলেছেন।

এই ধরুন রাতের খাবার দাবার সব শেষ করে মা সবার শেষে ঘুমোতে যান। আবার সবার আগে ঘুম থেকে উঠেন। সকালে উঠে এই আপনার জন্য নাস্তা প্রস্তুত করে রাখেন। কই একদিনও কি মা বলেছেন, আমি আর রান্না করতে পাবর না। কোন দিন কি মা সন্তানের কাছে কোন বায়না ধরেন। আমাকে নিয়ে মায়ের, বাবার কত চিন্তা। তাদের সারা দিনের কাজ, আয় রোজগার সব আমাকে আপনাকে ঘিরেই। এত কষ্ট, এত পরিশ্রম শুধু শুধু আপনার জন্যই। আপনাকে নিয়ে আপনি ভাবুন। আপনার সন্তানের জন্য আপনি কি করছেন। আপনার পিতা মাতা আপনার জন্য কি এর চেয়ে কম করেছেন। আপনি এখন আপনার বৃদ্ধ মা বাবার সাথে যা করছেন। আপনার ছেলে যদি আপনার সাথে এমন আচরণ করে, কেমন লাগবে। একটু সময়ের জন্য আপনি আপনার পিতার অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করুন অথবা আয়নার সামনে যান। আয়নায় নিজের চেহারাটির তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করুন তো সে সহ্য করতে পারবে কি না!

বলুন মা বাবা আপনার কাছে কি চায়, ১০ তলা বাড়ি, দামি গাড়ি, স্বর্ণের গহনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কি তাদের চাহিদার ফর্দ কি দেখাতে পারবেন। আপনাকে দেওয়া তাদের উপহার, বখশিশের তালিকা থেকে কি তাদের তালিকা খুব লম্বা। না তা কখনই নয়। তাদের চাহিদার তালিকা খুব ছোট। তারা চায় তিন বেলা খাবার, একটু হাসিখুশি ব্যবহার এই এইটুকুইতো। না আর অন্য কিছু।

আপনি অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করছেন। মা ক্লান্ত তারপরও মা আপনার পাশে বসে আছেন। শরীর চাচ্ছে ঘুমোতে কিন্ত এই আপনার আমার জন্য মা ঘুমোচ্ছেন না। বাবা সেই সকালে কৃষি কাজে, ব্যবসা বা অফিসে যান, ক্লান্ত শ্রান্ত। বলুনতো কি জন্য তাদের দুটি মানুষের জন্য। দাদা দাদী থাকলে তাদের এই চারটি মানুষের জন্য কি বাবার এতো পরিশ্রম? না, তা কিন্তু নয়। এই আমার জন্যই বাবার এতো পরিশ্রম। আমাকে কীভাবে গড়ে তুলবেন। আমাকে কী দিয়ে যাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভারতের ঐ বোনটি আত্মহত্যা করে ভাল কাজ করেনি। কিন্তু তার আকুতি হৃদয় নাড়া না দিয়ে পারে না। আমাদের অবস্থা কত নিবিড় ভাবে সে দেখেছে। কত অভিমান আর দুঃখ তার ভিতরে জেগেছে। আমাদের শপথ নিতে হবে। আর কোন মা বাবা বৃদ্ধাশ্রমে যাবে না। যে কুলাঙ্গার মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে। তাকে সামাজিক ভাবে চরম বয়কট করতে হবে। যে যদি কোন পদ পদবি ধারী হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে তা কেড়ে নিতে হবে। এমন কুলাঙ্গার সমাজের, রাষ্ট্রের কোন উপকার করতে পারে না। সে এই সমাজের বিষফোঁড়া। বিষফোঁড়াকে কেউ যতন করে লালন করে না। অপারেশন করে কেটে ফেলে। 

লেখক:

কবি ও প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here