।। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল।।
শিক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠায়
অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা ও ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুনের ক্ষেত্রে যে ক’জন প্রথিতযশা আলেম নির্মোহভাবে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে
মাওলানা মোহাম্মদ ফৈয়াজ আলী খান বিশিষ্টতায় সমুজ্জ্বল। বৃহত্তর সিলেট ও তৎকালীন আসাম
অঞ্চলে সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট আলেমে দীন, শিক্ষাবিদ, ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ ফৈয়াজ আলী
খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলাম ও নির্যাতিত-নিপীড়িত মুসলমানদের খেদমতে তাঁর
নিষ্ঠা ও অসামান্য অবদান সর্বজনবিদিত। ‘কেতাবুজ্ জেহাদ’ মাওলানা মোহাম্মদ ফৈয়াজ আলী খান রচিত জেহাদ ও মাসায়েল বিষয়ক
একটি চুম্বক-পুস্তিকা। এতে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান জেহাদ-এর গুরুত্ব, প্রেক্ষাপট ও অতি জরুরি মাসায়েল স্থান পেয়েছে। তৎকালীন মুসলিম
নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে তিনি পুস্তিকাটি রচনা করেন। এটি যেমন উপমহাদেশের সে সময়কার
মুসলিম নিপীড়নের প্রেক্ষিতে সময়োপযোগী ছিলো এবং মুসলমানদের পথনির্দেশনা দিয়েছে তেমনই
যুগে যুগে বিপদগ্রস্ত মুসলমানদের মুক্তি ও পথের দিশা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে
চলেছে নিঃসন্দেহে।
বিশেষ করে মুসলমানরা
যখন চারদিক দিয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে তখন আল্লাহর সাহায্য কামনা করে কুনুতে নাজেলা
(নামাজে বিশেষ দোয়া) আমল করার সহিহ পদ্ধতি এ পুস্তিকায় সন্নিবেশিত হয়েছে। উল্লেখ্য
‘কেতাবুজ্ জেহাদ’ (১৯৬৫) প্রকাশের পর মুসলমানেরা এটা আমল করার মাধ্যমে বিশেষ উপকারিতা লাভ করেছিল।
‘কেতাবুজ্ জেহাদ’-এর লেখকের পুরো নাম আবুল ওজিহ মোহাম্মদ ফৈয়াজ আলী খান। পিতা
মুনশি মিয়া খান। বরেণ্য ও প্রাজ্ঞ আলেমে দীন মাওলানা ফৈয়াজ আলী খান ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে
বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা ইউনিয়নের কাকরদি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। কিছুদিন পর তাঁর মাতাও ইন্তেকাল করেন। পিতৃমাতৃহীন
ফৈয়াজ আলী অতঃপর ফুফু হাজি শরীফা বিবি ও আবেদা বিবি এবং বড়ো ভাই হাজি মুশাহিদ আলী খানের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেন। নিজ বাড়ির মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে প্রাথমিক
শিক্ষা লাভ করেন। পরে সিলেট ও কাছাড়ের দু’জন আলেমের কাছে
শিক্ষা লাভ শেষে ব্রিটিশ ভারতের উত্তরপ্রদেশের শাহরানপুর, রামপুর ও দারুল উলুম দেওবন্দে আরবি ও ইসলামি শিক্ষার উচ্চতর
সনদ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ।
কর্মজীবনের শুরুতে
সিলেট জেলার কানাইঘাটের গাছবাড়ি, গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি, সিলেট শহরের খেলাফত বিল্ডিং-এর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন (খেলাফত
আন্দোলনের পর)। পরে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় হেড মাওলানা পদে
নিয়োগ লাভ করেন। অক্লান্ত শ্রম, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার
সাথে তার অধ্যাপনা চলতে থাকে। অত্র প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে
অবসর গ্রহণ করেন। ইসলামের দাওয়াত, প্রচার-প্রসার তথা মুসলিম
মিল্লাতের নানামাত্রিক খেদমতে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। আখেরাতমুখী জীবন গঠন ও সমাজ
সংস্কারে তাঁর আন্তরিক নিষ্ঠা ও বলিষ্ঠতা ছিলো সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি ব্রিটিশ ভারতে
পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনে একজন প্রচারবিমুখ অথচ কর্মমুখর সংগঠক হিসেবে অবদান রাখেন।
মাওলানা ফৈয়াজ
আলী খান খেলাফত আন্দোলনকারী মাওলানা আব্দুল হক মোক্তারপুরী, মাওলানা আব্দুল মুছাব্বীর চৌধুরী প্রমুখের সমসাময়িক ছিলেন। উল্লেখ্য
যে,
ব্রিটিশ শাসনামলে আসাম প্রদেশ ও বৃহত্তর সিলেট জেলার শ্রেষ্ঠ
ইসলামি পন্ডিত হিসেবে খ্যাত মাওলানা মোহাম্মদ মুশাহিদ, Quit India Movement এর বৃহত্তর সিলেট ও অন্যান্য প্রদেশের প্রথম
সারির নেতা বাঘা গ্রামের মাওলানা মোহাম্মদ বশীর, শেখ মাওলানা আব্দুল করিম, মাওলানা শামছুল ইসলাম, স্বাধীন ভারতে কলকাতা সরকারি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ
তাহের,
পাকিস্তান আমলে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল হাই, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ
আব্দুল লতিফ,
মাওলানা আব্দুল আজিজ ও কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের আজীবন
সম্পাদক মৌলবি মুহম্মদ নুরুল হক প্রমুখ ফুলবাড়ি ও সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে
মাওলানা ফৈয়াজ আলী খানের ছাত্র ছিলেন।
এছাড়া ব্রিটিশ
আসামের সর্বশেষ কৃষিমন্ত্রী মাওলানা আব্দুর রশীদ, খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা ইব্রাহীম চতুলী, ব্রিটিশ আসাম ও পূর্বপাকিস্তানের মন্ত্রী আব্দুল হামিদ, আসামের প্রথম মুসলমান প্রিন্টার ও প্রকাশক মৌলভি আব্দুল গণি, মার্চেন্ট খান সাহেব আব্দুল কাহের, মোহাম্মদ ওসমান প্রমুখ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। মাওলানা ফৈয়াজ
আলী খান রচিত মাসায়েল সম্পর্কিত বইগুলো মৌলবি আব্দুল গণির ইসলামিয়া প্রেস থেকে সিলটি
নাগরি লিপিতে ছাপা হতো।
মাওলানা মোহাম্মদ
ফৈয়াজ আলী খান ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ আজিবুন্নেছা খাতুন-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ
হন। তাঁর পুত্র-কন্যারা হলেন : মরহুমা করিমা খাতুন, মরহুমা আবিদা খান,
মরহুম এ এইচ সা’দত খান, মরহুম ছাদ হুসেইন খান, মরহুম আমান উদ্দিন
খান,
মোঃ মাসউদ খান, মোঃ সউদ খান, মরহুমা নুরুন্নেছা খানম, মোছাম্মাৎ সালমা
খানম।
যুগের অন্যতম
মনীষী মাওলানা মোহাম্মদ ফৈয়াজ আলী খান ১১ জুন ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের আত্মজাগরণের
উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম শেষে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর নিবিড় সান্নিধ্যে
চলে যান।
দীন ইসলামের ঝাণ্ডাকে বুলন্দ করা আর শোষিত-নির্যাতিত মুসলমানদের সেবায় মাওলানা ফৈয়াজ
আলী খান ছিলেন একজন আপোশহীন মর্দে মুজাহিদ। তাঁর শিক্ষকতা, পান্ডিত্য মুসলমানদের আত্মোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো। আল্লাহ
এ আলেমে দীনের রুহের মাগফেরাত এবং একই সাথে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন।
0 coment rios:
You can comment here