স্মৃতিতে আয়নায় সর্ব জনাব মাও: ওলিউর রহমান
মো: ছালেহ আহমদ বেতকোণী
আল্লামা ইকবাল বলেছেন-
“খুদিকে এমনভাবে উন্নত কর, যাতে তোমার রব তোমার মৃত্যুর সময় আক্ষেপ করে বলেন, হায়! আমি কেন মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করলাম।”
এ কথাটি আল্লামা ইকবাল এমন লোক সম্পর্কে বলেছেন, যিনি তাঁর দুনিয়ার জিন্দেগীকে সুন্দরভাবে গড়তে সক্ষম হয়েছেন ও পরকালীন জীবনের জন্য রসদ যোগার করতে সতেষ্ট থেকেছেন। আর এধরনের জীবন গঠন করা খুবই কষ্টকর। শুধু তারাই এ জীবন গঠনে সক্ষম হবেন, যাদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ দয়া রয়েছে।
আমার প্রবল ধারণা সর্ব জনাব মাওঃ ওলিউর রহমান সাহেব অনুরূপ একজন মরদে মুজাহিদ, যার ব্যাপারে আল্লামা ইকবালের উপর্যুক্ত উক্তিটি শতভাগ প্রযোজ্য। মাওঃ ওলিউর রহমান সাহেব তাঁর চেষ্টা সাধনা পরোপকার সমাজ সংস্কার , বিচার আদালত প্রভৃতি জনকল্যানকর কাজের মাধ্যমে নিজেকে জন সমক্ষে পরোপকারী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমার সাথে কীর্তিমান পুরুষের অনেকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। বিশেষ করে সৎপুর পীর বাড়ি তার আত্মীয়তা থাকায় আর আমার লজিং থাকায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করতে আরও সুবিধা হয়েছিল। তাঁর বড় ছেলে মাওঃ নুরুর রহমান, সে সময়ে ছাত্র ছিল। আমাকে মামা বলে ডাকত। লজিং বাড়ির সম্পর্কের সুবাদে আমার সাথেও তাঁর সন্তানাদির সম্পর্ক গাঢ় হয়ে যায়। সম্পর্ক এতো গভীর হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল তাঁর সন্তানাদি আমার আপন ভাগনা-ভাগ্নি আর আমি তার ছোট ভাই। আমি সে সময় লেখাপড়ায় মোটামোটি মনোযোগি ছিলাম। লেখা পড়ার টেবিলে প্রায় রাত ১২টা ১টা হয়ে যেত। তিনি শ্বশুর বাড়ি আসলে আমাকে ফলো করতেন। মাঝে মধ্যে লেখা পড়ার খোঁজ নিতেন। সন্তানাদিকে উৎসাহিত করতেন। তাঁদের সামনে আমাকে উদাহরণ দেখিয়ে উদাহরণ দিতেন।
একদিন উনার বাড়িতে কি যেন একটি ব্যাপারে গিয়েছিলাম। রাতে খুব ভালো করে খাওয়া দাওয়া হলো। এরপর বসলো গল্পের আসর। গল্প অন্য কোন বিষয়ে নয়। লেখাপড়া ছিল মূল উদ্দেশ্য। জ্ঞানের প্রতি কতটুকু অনুরাগ তার ছিল, আমি সেদিন বুঝতে সক্ষম হলাম। তিনি তাঁর ছেলে নুরুর রহমানকে একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। সে আবছা আবছা উত্তর দিল। এরপর তাঁর শ্যালক পীর বাড়ির কবিন আহমদ বুলবুলকে প্রশ্ন করলেন। সে একটু ভাল উত্তর দিল। এরপর তিনি সবার উদ্দেশ্যে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আমি কোনদিন ভুলব না। তিনি বললেন, “নিজের জীবন নিজেই গঠন করবে মায়ের পেঠের ভেতর থেকে কেহই অভিজ্ঞতা নিয়ে জন্মায় না। মানুষ যা পায় সে তার চেষ্টা সাধনার বদৌলতেই পেয়ে থাকে। এরপর তিনি একটি কবিতার কয়েক লাইন পাঠ করে শুনালেন। তা হল-
প্রথম যখন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে তুমি শুধু হেসেছিল সবে।
এমন জীবন তুমি কর হে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।
মানুষের জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ই বিদ্যমান থাকে যাদের সফলতার দিক প্রবল হয় তারা হলেন কীর্তিমান। আমি এ মহান ব্যক্তিত্বের সফলতার দিকটাই বড় করে দেখেছি। শিক্ষা জীবন শেষ করে মানুষ গড়ার কারখানাতে মনোনিবেশ করেন। সর্ব প্রথম বুরাইয়া মাদ্রাসার মুহতানিম হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি এ প্রতিষ্ঠানটিকে দাখিল স্তর থেকে আলিম স্তরে উন্নিত করেন। অতঃপর বিশেষ প্রয়োজনে জীবন ও জীবিকার তাগিদে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন। তেলিকোনা (এলাহাবাদ) প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ইহাতে সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি জন কল্যানমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এলাকার গরীব অসহায় লোকদের বাড়িতে টিউবওয়েল স্থাপন, বিধবা নারীদের বিভিন্ন সহযোগিতা, গরীব লোকের চাল মেরামত টিন সংগ্রহ ও স্থানীয় রাস্তাঘাট মেরামতে তার সহযোগিতা ছিল হাতের নাগালে। তেলিকোনা (এলাহাবাদ) আলিম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার অবদার ছিল অনস্বীকার্য। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এলাকার মানুষের অনেক উপকার সাধিত হয়েছে। এ উপকারের কথা মানুষ ভুলতে পারেনি। তাই অশ্্রুসিক্ত নয়নে তাকে শেষ বিদায় জানাতে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। জানাযায় নেমেছিল মানুষের ঢল।
তিনি ছিলেন আপোষহীন ও ন্যায়ের পথে ধ্বজাধারী আলিমে দ্বীন। বিভিন্ন শরয়ী মাসায়িলের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সত্যের সন্ধানী। তিনি যা বুঝতেন, সে অনুযায়ী আমল করতেন। কোনো ব্যাপারে বাধা বিপত্তি তাকে আটকাতে পারতো না।
প্রশাসনের লোকদের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল খুবই গভীর। তাঁরা তাঁকে একজন সুবিবেচক, বুদ্ধিমান ও দক্ষ অভিভাবক হিসেবে মূল্যায়ণ করতেন। তাদের একজন বলেই ফেললেন, “আজ আমরা অভিভাবক হারা, আমরা একজন দক্ষ অভিভাবককে হারালাম।” তার সন্তানাদির প্রায় সকলেই সুশিক্ষিত। ধনে, জনে, জ্ঞানে-গরীমায় সবাই সু প্রতিষ্ঠিত। এটা আল্লাহ তায়ালার দান ও তাঁর চেষ্টা। মাওঃ ওলিউর রহমান তাঁর চেষ্টা ও সাধনায় অত্র এলাকার মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। যার ফলে এরকম একজন কীর্তিমান মানুষের জন্য আপামর জনগনের আক্ষেপ ও প্রত্যাশা। কিন্তু বিধির বিধান হল যে- যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না। মানুষ অনেক খোঁজাখুঁজি করে, কিন্তু তাকে পায় না। কবি বলেন,- আদমি চল যাতা হয়ে, পির আতা নেহি, লোগ ঢুংনডতা হায় মাগার পাতা নেহি। অর্থাৎ মানুষ চলে যায় আর ফিরে আসেনা, লোকেরা তালাশ করে কিন্তু পায় না।
পরিশেষে দোয়া করি, মহান সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন আর আমাদেরকে ও তার কীর্তিমান জীবন থেকে শিক্ষা হাসিল করার তাওফিক দান করেন। আমিন।
মোঃ ছালেহ আহমদ বেতকোণী
প্রধান মুহাদ্দিস
সৎপুর কামিল মাদ্রাসা।
0 coment rios:
You can comment here